১৯ জুলাই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আন্দোলন রূপ নেয় অগ্নিশিখায়

জাতীয় | 19th July, 2025 7:46 am
চব্বিশের ১৯ জুলাই। ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় অগ্নিশিখায়। দিনভর সংঘর্ষে এদিন দেশজুড়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ জনে। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বাস্তবায়নে ফুঁসে উঠে ছাত্র-জনতা। বুলেটের জবাব দিতে একাট্টা গোটা দেশ। বিক্ষোভ দমাতে তখন মরিয়া স্বৈরাচারও। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে, আইশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীল ক্যাডারদের সর্বোচ্চ নির্দেশনা দেয়া হয়। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও ছোড়া হয় গুলি। সবমিলিয়ে বিভিষীকার শহরে পরিণত হয় ঢাকা। এদিন রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করা হয়।
রাজধানীর বাতাসে বারুদের গন্ধ, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় টিকে থাকা দায়। সড়কগুলো দেখলে মনে হবে যেন এক বিধ্বস্ত জনপদ। ঢাকার রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেট, কুড়িল, মহাখালী, উত্তরা—প্রতিটি পয়েন্টেই একই চিত্র।
রাজপথ থেকে আন্দোলনকারীদের হটাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। নির্বিচারে চালানো হয় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল। যেন এক যুদ্ধপরিস্থিতি। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা আর গুজবের নগরীতে পরিণত হয় দেশ।
গুলশান-১ এ ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর দুটি বেসরকারি ভবনে ভাঙচুর করা হয়। মহাখালীতে রেল ও সড়ক অবরোধ করে দুটি গাড়িতে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। এছাড়া নিউমার্কেটে পুলিশ ফাঁড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।
এদিন সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় যাত্রাবাড়ী এলাকায়। দিনভর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আর পুলিশ-বিজিবির অ্যাকশানে প্রকম্পিত হয় গোটা এলাকা। হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তবে রাতে সংঘর্ষের মাত্রা বাড়ে কয়েকগুণ। পুলিশের সাথে থেমে থেমে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ আশপাশের এলাকায় বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। একই সময়ে হামলা চালানো হয় স্বৈরাচারের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত বিটিভিতেও।
মালিবাগ রেলগেট এলাকা থেকে রামপুরার বিটিভি ভবন পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার সড়কের পুরোটা জুড়ে অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। চলমান আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ তারা।
সারাদেশ থেকে যখন হতাহতে খবর আসতে থাকে তখন আর ঘরে বসে থাকেনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। জীবন তুচ্ছ করে যুক্ত হন আন্দোলনে। তাদের দমাতে কুড়িলে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল ছোড়ে র্যাব। সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে তারা।
ঢাকার আরেক প্রান্ত উত্তরা এলাকায় এদিনে ব্যাপক সহিংসতা হয়। যাতে হতাহতের সংখাও নেহায়েত কম নয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরেও পুলিশের সাথে একটি পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে দিনব্যাপী।
সকাল থেকেই একের পর এক মরদেহ পৌঁছাতে থাকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। নিহত ৩০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিলো যাত্রাবাড়ীতে—মোট ৫ জন। শতাধিক আহতের মধ্যে অনেকে ভর্তি হয় ঢামেকে, বাকিরা শহরের অন্যান্য হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসা নেন।
এরমাঝেই হুঙ্কার দিয়ে উঠেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ। হুঁশিয়ারি দেন—সকল বিশৃঙ্খলাকারী ও তাদের সহায়তাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেন—আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ভর করেছে, শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে গুলি ও কারফিউর নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেছেন—সরকার নিজেই দায়ী, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে।
সকালে জাদুঘরের সামনে ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন অভিভাবকরা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন অনেকে। রাজধানীজুড়ে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট ও যান চলাচল। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এদিন রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা দেয় সরকার। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণভবনে ১৪ দলের সাথে বৈঠকের পর আওয়ামি লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই রাতেই দেশজুড়ে কারফিউ ও সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি নিতে থাকে আইনশৃংখলা বাহিনী।